বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বহুমাত্রিক। দুটি দেশই একই সাংস্কৃতিক, ভাষাগত, এবং ঐতিহাসিক শিকড়ের উত্তরাধিকারী, যা তাদের মধ্যে একটি বিশেষ সম্পর্ক তৈরি করেছে। তবে, এই সম্পর্কের মধ্যে রয়েছে কিছু ঐক্য এবং বিভেদ, যা বিভিন্ন সময়ে উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশ এবং ভারতের সম্পর্কের ইতিহাস
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিদের সমর্থন দেন এবং ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়। ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সক্রিয় সহযোগিতা এবং সামরিক হস্তক্ষেপের ফলস্বরূপ পাকিস্তান পরাজিত হয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। এই সময়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং সহযোগিতামূলক।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন এবং দেশের পুনর্গঠনে ভারতের অবদান অপরিসীম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখে এবং দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন চুক্তি ও সহযোগিতার মাধ্যমে সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়। ১৯৭২ সালে দুই দেশের মধ্যে “মৈত্রী চুক্তি” স্বাক্ষরিত হয়, যা পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার লক্ষ্যে গৃহীত হয়েছিল।
দুই বাংলার মধ্যে রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক সম্পর্কের বিবর্তন
বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক সম্পর্কের ইতিহাস বেশ জটিল এবং নানা ওঠানামার মধ্য দিয়ে গিয়েছে। যদিও দুই দেশ একই সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের অংশীদার, তবে বিভিন্ন সময়ে তাদের মধ্যে মতবিরোধ এবং বিভেদও দেখা গেছে।
১৯৭৫ এর পর:
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন যুগের সূচনা হয়। এই সময়ে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক কিছুটা শীতল হয়ে পড়ে। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে নতুন সরকার ভারত থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে একটি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি গড়ে তোলার চেষ্টা করে। এরপর এরশাদ আমলেও একই ধরনের প্রবণতা দেখা যায়।
১৯৯০ এর দশক এবং এর পর:
১৯৯০ এর দশকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পর বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তিত হয় এবং এর সঙ্গে সঙ্গে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের নতুন অধ্যায় শুরু হয়। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে এবং ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক আবারও ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করে। তিস্তা নদীর পানিবণ্টন, ছিটমহল বিনিময়, সীমান্ত সমস্যা সমাধানসহ বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক ইস্যুতে আলোচনা এবং চুক্তি সম্পন্ন হয়।
২০১০ এর দশক:
২০১০ এর দশকে বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হয়, বিশেষত সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা, বাণিজ্য সম্প্রসারণ, এবং আঞ্চলিক সংযোগ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে। শেখ হাসিনার সরকার এবং ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং পরে নরেন্দ্র মোদির সরকারের মধ্যে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
তবে, দুই দেশের মধ্যে কিছু সমস্যাও রয়ে গেছে, যেমন তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে মতবিরোধ এবং সীমান্ত সমস্যাগুলি। এই সমস্যাগুলোর সমাধান দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
দুই বাংলার ঐক্য এবং বিভেদ
বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ—এই দুই বাংলা সাংস্কৃতিক, ভাষাগত, এবং ঐতিহাসিকভাবে অদৃশ্য সেতু দ্বারা সংযুক্ত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, এবং অন্যান্য সাহিত্যিকদের সৃষ্টিকর্ম দুই বাংলার মানুষকে একত্রিত করে। তবে, রাজনৈতিক এবং ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে দুই বাংলার মধ্যে বিভেদও বিদ্যমান।
সীমান্ত, বাণিজ্য, এবং অভিবাসন সংক্রান্ত ইস্যুতে দুই বাংলার মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। তবে, এই বিভেদগুলি সত্ত্বেও দুই বাংলার মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক সংযোগ অত্যন্ত শক্তিশালী এবং দুই পক্ষই একে অপরের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব পোষণ করে।
সমাপ্তি
বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের ইতিহাস উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে, তবে উভয় দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক বন্ধন সবসময়ই দৃঢ় থেকেছে। দুই দেশের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক উদ্যোগের উপর, যা উভয় পক্ষের জন্য কল্যাণকর হতে পারে। দুই বাংলার ঐক্য এবং বিভেদ নিয়েও ভবিষ্যতে আরও আলোচনার এবং সমঝোতার প্রয়োজন রয়েছে।