Home রাজনীতি বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন: বঙ্গের ঐক্যের লড়াই

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন: বঙ্গের ঐক্যের লড়াই

0
বঙ্গের ঐক্যের লড়াই

১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বাংলার ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং চিরস্মরণীয় ঘটনা। এটি ছিল ব্রিটিশ শাসনের অধীনে বাংলার প্রাদেশিক বিভাজন, যা বাংলার মানুষদের ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধের পথ দেখিয়েছিল। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে বাঙালিরা যে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, তা শুধু বাংলার নয়, সমগ্র ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়।

১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ: পটভূমি ও প্রেক্ষাপট

ব্রিটিশ শাসকেরা ১৯০৫ সালে বাংলা প্রদেশকে দুই ভাগে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়। লর্ড কার্জন এই পরিকল্পনার মূল উদ্যোক্তা ছিলেন এবং তার লক্ষ্য ছিল বাংলার জনসংখ্যার ভারসাম্য রক্ষা এবং প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি। তবে, এর আসল উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের ক্রমবর্ধমান শক্তিকে দুর্বল করা। বাংলার একদিকে ছিল কলকাতা কেন্দ্রিক হিন্দু বাঙালিদের প্রভাবশালী অঞ্চল, আর অন্যদিকে ছিল পূর্ব বাংলার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা।

ব্রিটিশ শাসকদের মতে, বঙ্গভঙ্গ ছিল প্রশাসনিক সুবিধার জন্য একটি যৌক্তিক পদক্ষেপ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, এটি ছিল “Divide and Rule” নীতির একটি কৌশল, যার মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দুর্বল করে দেওয়া। বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে বাঙালিদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টি করা হয়েছিল, যা বাঙালি সমাজে গভীর প্রভাব ফেলেছিল।

বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলন: বাঙালির ঐক্য ও প্রতিরোধ

বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে বাঙালিরা ব্যাপকভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিরোধের পথে নামে। এই প্রতিরোধ আন্দোলনটি “স্বদেশি আন্দোলন” নামে পরিচিত। বাঙালিরা ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের শপথ নেয় এবং দেশীয় পণ্য ব্যবহারে উৎসাহী হয়। “স্বদেশি” শব্দটি তৎকালীন বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রতীক হয়ে ওঠে।

বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে সংগঠিত হয় অসংখ্য মিছিল, সভা, এবং গণআন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই সময়ে “আমার সোনার বাংলা” গানটি রচনা করেন, যা বাঙালির ঐক্যের প্রতীক হিসেবে গাওয়া হয়। কলকাতা, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বাংলার বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে বাঙালি হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে একত্রিত হয়ে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদ জানায়।

এছাড়া, অরবিন্দ ঘোষ, বাল গঙ্গাধর তিলক, বিপিনচন্দ্র পাল প্রমুখ নেতারা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে। স্বদেশি আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটে এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালির মনোভাব আরও কঠোর হয়।

বঙ্গভঙ্গের প্রভাব এবং পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনাবলী

বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে বাঙালির ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ফলে ব্রিটিশ সরকার ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। এই প্রত্যাহারের মাধ্যমে বাঙালিরা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিজয় অর্জন করে এবং তা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

বঙ্গভঙ্গের প্রত্যাহার বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জন্য একটি বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে, বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপটেই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মতো সংগঠনের মধ্যে দুটি ভিন্ন ধারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে—উদারপন্থী ও চরমপন্থী। এই বিভাজন পরবর্তী সময়ে ভারতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন বাংলার সমাজ ও রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। এটি বাঙালির ঐক্য এবং সাংস্কৃতিক চেতনাকে নতুন করে জাগ্রত করেছিল। বাঙালিরা বুঝতে পেরেছিল যে, তাদের ঐক্যবদ্ধ থাকলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মতো শক্তিরও বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনায় এক নতুন মাত্রা যোগ করে এবং পরবর্তী স্বাধীনতা সংগ্রামে তা অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে।

সমাপ্তি

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন বাংলার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যা বাঙালির ঐক্য এবং প্রতিরোধের প্রতীক। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে এবং তা পরবর্তী সময়ে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বঙ্গভঙ্গের এই ইতিহাস আমাদের শেখায়, ঐক্যবদ্ধ থেকে যেকোনো প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব, এবং এটি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি মহত্তম উদাহরণ হয়ে থাকবে।

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version